তারেকুল ইসলাম :
সম্প্রতি ভারতে জি-২০ সম্মেলনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সাথে দেখা হয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। সাক্ষাৎটা অনানুষ্ঠানিক ছিল। বাইডেন তার স্বভাবজাত আচরণ অনুযায়ী একটি সেলফি তোলেন। এই সেলফি দেখে গোটা আওয়ামী শিবিরে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। যেন আমেরিকা ম্যানেজ হয়ে গেছে। সেলফিটা আসলে তাদের জন্য একটি ইল্যুশন মাত্র। কারণ বিশ^রাজনীতিতে এমন সেলফি কিংবা ফটোর বিশেষ প্রভাব নেই।
লিবিয়ার সাবেক স্বৈরশাসক গাদ্দাফির পতনের এক বছর আগেও ইতালিতে আয়োজিত এক জি-৮ সম্মেলনে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ও মুয়াম্মার গাদ্দাফি সৌহার্দ্যপূর্ণ করমর্দনসহ একসঙ্গে ডিনার করেন। এ ছাড়া ফ্রান্সের সাবেক প্রেসিডেন্ট নিকোলাস সারকোজির সাথেও গাদ্দাফির ব্যক্তিগত সুসম্পর্কের বিষয়টি সবার জানা। এমনকি ২০০৭ সালে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী সারকোজিকে নির্বাচনী প্রচারণার জন্য গাদ্দাফি পাঁচ মিলিয়ন ইউরো দেন বলে অভিযোগ আছে। অথচ সেই সারকোজি প্রেসিডেন্ট থাকাবস্থায় ফ্রান্স গাদ্দাফির উৎখাতে আমেরিকার নেতৃত্বাধীন ন্যাটোর আগ্রাসনে অংশ নেয়। সুতরাং, বিশ্বরাজনীতি বড়ই কঠিন। ব্যক্তিগত দহরম-মহরম এ ক্ষেত্রে কোনো কাজে আসে না। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নিয়ে যাদের ধারণা আছে, তারা জানেন, বাইডেনের এক সেলফিতে আমেরিকার নীতি পরিবর্তন হওয়ার চিন্তা কতটা উদ্ভট।
যা হোক, বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় নির্বাচন এখন আন্তর্জাতিক ইস্যু। গোটা পশ্চিমা বিশ^ তাকিয়ে আছে। তারা ক্ষমতাসীন সরকারকে ক্রমাগত চাপ দিয়ে যাচ্ছে। চীন ও রাশিয়ার সমর্থন থাকা সত্ত্বেও এই চাপ মোকাবেলা করতে পারছে না সরকার। বিশেষ করে ভারতকে এই সরকারের পাশে আগের মতো দাঁড়াতে দেখা যাচ্ছে না। বরং জি-২০ সম্মেলনের আগে ভারতীয় দৈনিক দ্য টেলিগ্রাফ ভারতের সিকিউরিটি এস্টাবলিশমেন্টের বরাতে জানিয়েছিল, জি-২০ সম্মেলনে ভারত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে দুটো বার্তা দিতে পারে : ১. নির্বাচন অবশ্যই অবাধ ও সুষ্ঠু হতে হবে; ২. আওয়ামী লীগ থেকে চীনপন্থী ও ইসলামপন্থীদের প্রতি অনুরাগীদের বাদ দিতে হবে। পত্রিকাটি আরো বলেছে, বার্তা দুটি বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় নির্বাচন নিয়ে আমেরিকা ও ভারতের মধ্যে বিশদ ঐকমত্যের (ধ নৎড়ধফ পড়হংবহংঁং) ইঙ্গিত দেয়। (২১ আগস্ট ২০২৩)। এমতাবস্থায় বাইডেনের এক সেলফিতে পরিস্থিতি বদলে যাবে- এমন ভাবার কোনো যুক্তি নেই। তা ছাড়া জি-২০ সম্মেলনের ঠিক আগেই রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ ঢাকায় এসে যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও তাতে সুর মিলিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের ব্রিফিংয়ে মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার ল্যাভরভের বক্তব্যের কড়া সমালোচনা করেছেন। সুতরাং, বাইডেনের সেলফি দিয়ে দলীয় নেতাকর্মীদের সাময়িক চাঙ্গা করা ছাড়া কাজের কাজ কিছুই হবে না।
অন্য দিকে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চেয়ারের পাশে ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাকের হাঁটু গেড়ে বসার ছবি ব্রিটেনে সুনাককে সমালোচনার মুখে ফেলেছে। বয়স্কজনের সামনে এ ধরনের বিনয় প্রকাশ প্রাচ্যের একটি স্বাভাবিক কালচার। কিন্তু অনুমতি ছাড়া কারো এ ধরনের আটপৌরে ব্যক্তিগত মুহূর্তের ছবি তোলা উচিত নয়। অথচ হীন রাজনৈতিক প্রচারণার স্বার্থে সেই ছবি তুলে ভাইরাল করে দেয়া হলো। লক্ষণীয়, সমালোচনার মূল লক্ষ্যবস্তু তুলে ধরে ব্রিটেনের প্রভাবশালী পত্রিকা ডেইলি মেল লিখেছে, ‘বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সামনে ঋষি সুনাকের হাঁটু গেড়ে বসার ছবি নিন্দার মুখে পড়েছে। এমন একজনের সামনে তিনি হাঁটু গেড়ে বসেছেন, যার সরকারের বিরুদ্ধে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন চলছে এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের রিপোর্ট হচ্ছে।’ রাজনৈতিকভাবে কতটা দেউলিয়া হলে আওয়ামী লীগের মতো একটি বড় রাজনৈতিক দলকে আজ সামান্য সেলফি বা ফটোকে খড়কুটো হিসেবে আঁকড়ে ধরতে হচ্ছে! সন্দেহ নেই, বৈধতার সঙ্কটই আওয়ামী সরকারের এই রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বের কারণ।
গণতান্ত্রিক বৈধতার সঙ্কটের কারণে চীন, রাশিয়া ও ভারত ছাড়া আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ক্ষমতাসীন দলের আর কোনো বন্ধু দেখা যাচ্ছে না। তবে পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ও শ্রীলঙ্কার রাজাপাকসে পরিবারের পতনের সময় চীন এগিয়ে আসেনি। ফলে চীনের ওপর ভরসা করা কঠিন। আর ইউক্রেনে যুদ্ধরত রাশিয়া এতটাই বেকায়দায় রয়েছে যে, লিপ সার্ভিস ছাড়া বাস্তব পদক্ষেপ দেশটির পক্ষ থেকে আশা করা দুরূহ। অন্য দিকে, দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের প্রভাব ঠেকানোর নীতিতে ভারত যুক্তরাষ্ট্রের সাথে জোটবদ্ধ। বাংলাদেশে সুষ্ঠু, অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র নীতিগতভাবে শক্ত অবস্থান নেয়ায় ভারত এবার বাংলাদেশের নির্বাচনের ব্যাপারে নিষ্ক্রিয় থাকতে বাধ্য হচ্ছে। মিডিয়ায় মাঝে মধ্যে বাইডেনকে বাংলাদেশ বিষয়ে মোদির বার্তা দেয়ার হাইপ তোলা হলেও বাস্তবে সেরকম কিছু দেখা যায়নি। এ ছাড়া ভারতের বৈদেশিক মুদ্রার তৃতীয় বৃহত্তম উৎস বাংলাদেশ। ফলে আরেকটি বিতর্কিত নির্বাচনের জেরে বাংলাদেশের ওপর সম্ভাব্য অর্থনৈতিক স্যাংশন এলে ভারতও আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
সুতরাং, ভারতের পক্ষে সম্ভব নয় আগের মতো বাংলাদেশের ব্যাপারে যেমন খুশি সিদ্ধান্ত নেয়ার। খোদ মোদি সরকারো নানা কারণে প্রশ্নবিদ্ধ। বিশেষ করে সংখ্যালঘুদের ওপর অমানবিক নির্যাতন, বিরোধী রাজনীতিক ও ভিন্নমতাবলম্বীদের হয়রানি, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ধ্বংস ইত্যাদি নানা ইস্যুতে মোদি সরকার চাপে রয়েছে। ফলে মোদি কোন মুখে বাইডেনের কাছে বাংলাদেশের কর্তৃত্ববাদী শাসনের পক্ষে ওকালতি করবেন! তা ছাড়া সদ্যসমাপ্ত জি-২০ সম্মেলন উপলক্ষে ভারত সফর শেষে বাইডেন ভিয়েতনামে পৌঁছেই সংবাদ সম্মেলনে ভারতের গণমাধ্যম, মানবাধিকার ও বাক-স্বাধীনতা ইস্যুতে মোদির সমালোচনা করেন। ওয়াশিংটন থেকে অভিযোগ করা হয়, মোদি-বাইডেন দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পর বাইডেনকে ভারতে সংবাদ সম্মেলন করতে দেয়া হয়নি।
যাই হোক, ভারতের বৃহৎ সংবাদ সংস্থা পিটিআই ‘লাইফ সাপোর্টে বাংলাদেশের গণতন্ত্র’ শীর্ষক তাদের এক প্রতিবেদনে লিখেছে, ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থা এখন অনেকটাই রাশিয়ার মতো; একদল অলিগার্ক প্রচুর আর্থিক সুবিধা ভোগ করছে এবং বর্তমান সরকারকে ক্ষমতায় রাখতে বিপুল পরিমাণে বিনিয়োগ করেছে। একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনই সম্ভবত বাংলাদেশের কর্তৃত্ববাদী অগ্রযাত্রা থামাতে পারবে এবং বৃহত্তর জবাবদিহির পথ সুগম করবে’ (১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩, দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া)। কিন্তু আমাদের ক্ষমতাসীন দল প্রকৃত সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনকে ভয় পাচ্ছে। তারা ক্ষমতা ধরে রাখতে এতটাই মরিয়া যে, আন্তর্জাতিক সব চাপ উপেক্ষার চেষ্টা করছে। কিন্তু বিষয়টি এখন আর শুধু দেশীয় গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ নেই। এর সঙ্গে এখন বৃহদাকারে মার্কিন ফরেন পলিসি ও মিয়ানমারকে ঘিরে দক্ষিণ এশিয়ার নয়া ভূরাজনীতি জড়িয়ে পড়েছে।
কয়েক দিন আগে ঢাকা-লন্ডন ৫ম কৌশলগত সংলাপে ব্রিটেন একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও সহিংসতামুক্ত নির্বাচনের তাগিদ দিয়েছে এবং প্রয়োজনে এ ক্ষেত্রে সহায়তা দিতেও প্রস্তুত। বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতার স্বার্থে এবং এদেশে তাদের বিনিয়োগের গ্যারান্টিস্বরূপ তারা একটি সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন চায়। অন্যথায়, বিদ্যমান বিনিয়োগ হ্রাসকরণসহ দ্বিপক্ষীয় ব্যবসা-বাণিজ্য হুমকির মুখে পড়বে বলে তারা সতর্ক করেছে। সংলাপ শেষে পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা তাদের বলেছি সুষ্ঠু নির্বাচন করতে আমরা সক্ষম।’ সিইসি আবদুল আউয়াল বলেছেন, ‘আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।’ সঙ্গত কারণে প্রশ্ন ওঠে, নির্বাচন কমিশন যদি সত্যিই স্বাধীন ও সক্ষম, তাহলে ইসির কেন প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতির দরকার পড়ল?
সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ, সরকারি নির্দেশনায় রাজনৈতিক মামলাগুলোর দ্রুত নিষ্পত্তি করা হচ্ছে। বিরোধী নেতাকর্মীদের আবারো জেলে ঢুকিয়ে মাঠ শূন্য করার পাঁয়তারা চলছে। এ ছাড়া, মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’-এর সম্পাদক আদিলুর রহমান শুভ্র ও পরিচালক নাসির উদ্দিন এলানকে দুই বছর করে কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। এতে মার্কিন দূতাবাস উদ্বেগ জানিয়ে বলেছে, ‘এই রায় মানবাধিকারকর্মী ও সুশীলসমাজের গুরুত্বপূর্ণ গণতান্ত্রিক ভূমিকা পালনের সদিচ্ছাকে আরো দুর্বল করে দিতে পারে।’ মানবাধিকারকর্মী ও বিরোধীদের কোণঠাসা করে জাতীয় নির্বাচন কখনো সুষ্ঠু ও অবাধ হতে পারে না তা বলাই বাহুল্য। ইউরোপীয় পার্লামেন্ট বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতির অবনতিতে গভীর উদ্বেগ জানিয়ে এক যৌথ প্রস্তাবে নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার চর্চার বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারকে আন্তর্জাতিক চুক্তি অনুসরণের আহ্বান জানিয়েছে। সুতরাং, অন্ধ হলেই প্রলয় বন্ধ হয়ে যায় না।
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক